বাঙালির ঘরে ছবি
বাংলা ইতিহাসে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান চর্চার এক অন্যতম গবেষক ছিলেন সিদ্ধার্থ ঘোষ (১৯৪৮-২০০২)। ঔপনিবেশিক ও উত্তর-পরবর্তী বাংলায় চিত্র-তৈরি এবং চিত্র কৌশল সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ গবেষণা করেছিলেন তিনি। তিনি একজন বহুমাত্রিক প্রাবন্ধিক এবং কথাসাহিত্যিকও ছিলেন—কল্পসাহিত্য এবং বাংলা সাহিত্যের সংস্কৃতি বাদে সংগীত এবং খেলাধুলার মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়েও লিখেছিলেন। তাঁর বই ‘ছবি তোলা’তে তিনি বাঙালিদের ফোটোগ্রাফি চর্চার এক সূক্ষ্ম ইতিহাস লিখেছিলেন যেটি ইংরিজি বা অন্য ভারতীয় ভাষায় দুর্লভ। সেই বই থেকে এই উদ্ধৃতিটি দেওয়া হল:
বাঙালির ঘরে ছবি একটা জ্যান্ত জিনিস। শুভ উৎসবে পিতৃপুরুষদের ছবিতে মালা পরানো হয়, সামনে জ্বালানো হয় ধূপ। দোলের দিন লোকান্তরিতের ছবির পায়ে আবির দিয়ে আমরা প্রনাম জানাই। স্বামী ও সন্তানদের রেখে যে ভাগ্যবতী বিদায় নিয়েছেন ছবিতে তাঁর সিঁথি সিঁদুর-রাঙা, কপালে চন্দনের ফোঁটা। ফোটোগ্রাফ বিনা শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অঙ্গহানি ঘটে।
বাঙালির লৌকিক ও ধর্মীয় জীবনে স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হতে ফোটোগ্রাফের বেশি সময় লাগেনি। রেলওয়ে, টেলিগ্রাফের আগমন ঘিরে যদি বা কিছু প্রশ্ন উঠেছিল, ফোটোগ্রাফকে আমরা বিদেশী জ্ঞানে বর্জন করার কথা ভাবিনি। ছবি তোলা বলতেই আমরা এখন ফোটোগ্রাফ গ্রহণের কথাই বুঝি। অথচ এমন এক দিন ছিল যখন প্রতিকৃতি আঁকার কাজটাকেই ছবি-তোলা বলা হতো। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের জীবনীতে লিখেছেন, “পিতামাতাকে কলিকাতায় আনাইয়া (বিদ্যাসাগর) জননীকে বলিলেন- “মা। পাইকপাড়া রাজাদের বাড়ীতে একজন খুব ভাল প’টো এসেছে (হডসন), তাহাঁর দ্বারা তোমার একখানি ছবি তুলাইয়া লইতে চাই।"
সুবল চন্দ্র মিত্রের বিদ্যাসাগর জীবনীতে একজন ‘মিঃ হডসন’-এর উল্লেখ আছে, যিনি পাইকপাড়া রাজ পরিবারের সদস্যদের প্রতিকৃতি আঁকার জন্য নিযুক্ত ছিলেন। এটি সমসাময়িক কথায়ে ‘ফটো’ শব্দের একটি অস্পষ্ট অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে—যা চিত্রিত বা ছবি তোলা, দুটোই বোঝাতে পারে।
ফোটোগ্রাফির আগমনে পোর্ট্রেট পেইন্টারদের জীবিকাচ্যুত হওয়া নিঃসন্দেহে দুঃখজনক, কিন্তু এটাও স্মরণ রাখা দরকার, যাঁরা এতদিন চিত্রশিল্পীদের দ্বারস্থ হওয়ার কথা কল্পনা করতে পারতেন না, সেই মধ্যবিত্তরা এবার ছবি তোলানোর সুযোগ পেলেন।