একজন মেয়রের মৃত্যু: শোকযাত্রার ভিডিও রেকর্ডিং ও প্রদর্শনী

৮ এপ্রিল ১৮৯৪। কলকাতার চৈতন্য লাইব্রেরী ও বিডন স্কয়ার সাহিত্য সমিতির আমন্ত্রণে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শোক সভায় বক্তব্য রেখে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। “টু পয়েট্‌স অ্যান্ড ডেথ” প্রবন্ধে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিশ্লেষণ করেছেন প্রবীণ কবি, এবং সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের প্রধান সমালোচক, নবীন চন্দ্র সেনের অস্বস্তির কারণ। নবীন চন্দ্রের মতে, হিন্দু হিসাবে যে কোন মানুষের কাছে শোক একান্তই ব্যক্তিগত এক অনুভূতি। সার্বজনীন ভাবে শোক প্রকাশ করা সেই অনুভূতির অবমূল্যায়ন ছাড়া কিছুই নয়। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেন যে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে, বাঙালীদের মধ্যে এক নতুন ধরণের “পাব্লিক” অথবা সমষ্টিগত পরিচিতির উত্থান সেই মুহূর্তে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। সাহিত্যিক হিসাবে তাঁদের কর্তব্য এই তরুণ “পাব্লিক”–কে তাঁদের রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার কিছু রীতি খুঁজে নিতে বা সৃষ্টি করতে সাহায্য করা। কিন্তু প্রযুক্তিগত এবং রাজনৈতিক কিছু কারণে এই “পাব্লিক”–এর মৃত্যুকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার যে কতটা বিবর্তন হবে অল্পদিনের মধ্যেই, তা হয়তো নবীন চন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ কেউই সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতে পারেন নি। ১৯২৫–এর জুন মাসে “দেশবন্ধু” চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর যা ঘটেছিল কলকাতার রাস্তাঘাটে এবং সিনেমা হলে, তা এই সার্বজনীন শোক প্রকাশের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যয়ের সুচনা করে।


চিত্তরঞ্জন দাশ। উইকিমিডিয়া কমন্‌স। পাবলিক ডোমেন।

চিত্তরঞ্জন দাশের শেষ কিছুদিন কাটে দারজিলিং–এ তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে, যার নাম “স্টেপ অ্যাসাইড”। ১৬ই জুন তাঁর মৃত্যুর পর, খবর ছড়িয়ে যায় দ্রুত বেগে। পৃথ্বীশ চন্দ্র রায়ের চিত্তরঞ্জন–জীবনী থেকে জানা যায়, পরের দিন সকালে বহু মানুষ জড় হয়েছিলেন দার্জিলিং স্টেশন পর্যন্ত তাঁর শেষ যাত্রার সাক্ষী হতে। এবং যখন অবশেষে দেহবাহী ট্রেন শিয়ালদহ ষ্টেশন পৌঁছায়, প্রায় তিন মাইল জুড়ে সাধারণ মানুষের এক বিরাট জমায়েত সেখানে উপস্থিত ছিল। গান্ধী আঁচ করতে পেরেছিলেন যে স্বরাজ্য পার্টি–র প্রতিষ্ঠাতা এবং কলকাতার প্রিয় মেয়রকে দেখতে মানুষ উদগ্রীব হয়ে থাকবেন। শিয়ালদহ পৌঁছনোর আগেই তিনি একটি আচরণ বিধি প্রকাশ করেন। তার ছ”টি নির্দেশনার মধ্যে ছিল, “দেহবাহী গাড়ির আশপাশে ভিড় করা যাবে না,” “অতিরিক্ত শব্দ করা যাবে না,” এবং, “নির্দিষ্ট কীর্তনীয়র দল ছাড়া আর কেউ গাড়ির সাথে চলতে পারবে না।” সাংবাদিক জে এল গার্ভিন কিছুটা ব্যাঙ্গ করে লিখেছিলেন যে, “গত বৃহস্পতিবার কলকাতার রাস্তায় যা ঘটে তা অভূতপূর্ব। বহুদিন ব্রিটিশ রাজ্যে এরকম আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায় নি।... ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের ধর্ম বা জাতীয়তা–বোধ জাগিয়ে তুলতে পারলে যে মাত্রায় উন্মত্ত ভক্তিলাভ করা যায়, পাশ্চাত্যে কখনই তা সম্ভব নয়।”


দার্জিলিঙের হিল কার্ট রোডে মহত্মা গান্ধী এবং অ্যানি বেসান্তের সাথে চিত্তরঞ্জন দাশ, ১৯২৫। গান্ধী হেরিটেজ পোর্টাল। উইকিমিডিয়া কমন্‌স। ক্রিয়েটিভ কমন্‌স অ্যাট্রিবিউশন-শেয়ার অ্যালাইক ৩.০ আনপোর্টেড।

গান্ধী বা গার্ভিন কি খেয়াল করেছিলেন যে বারো জন চিত্রগ্রাহক শিয়ালদহ থেকে কালীঘাট যাত্রার সমস্ত ঘটনা ভিডিও করছিলেন? ৩২ সেকেন্ডের একটি রেকর্ডিং ব্রিটিশ পাথে”র রয়টার্স হিস্টরিক কালেকশনের আর্কাইভে রয়েছে, যার থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে পৃথ্বীশ চন্দ্র রায় লোকসংখ্যা একটুও বাড়িয়ে বলেন নি। জনসমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে চোখে পড়ে উঁচু উঁচু কয়েকটা মঞ্চ – যার উপর দাঁড়িয়ে কারা যেন ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছেন – আর কিছু ফুলসজ্জিত, শোক–বার্তা লেখা ব্যানার। আরও দেখা যায় এক ঝাঁক বিরাট বিরাট হাত পাখা। এইরকম কোন প্রচলিত প্রথা কি তখন ছিল? হয়তো জুন মাসের তীব্র গরমের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় মাত্র – কি জানি। ভিডিও ক্লিপ–টা শুরু হয় এক ঝলক টাইটেল কার্ড দেখিয়ে, তাতে চিত্তরঞ্জনের বিষয়ে লেখা “কলকাতার প্রথম ভারতীয় মেয়র এবং মহান রাজনৈতিক নেতা।”


চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর বিরাট শোকযাত্রার স্থিরচিত্র। সূত্র: ফিউনারেল প্রসেশন অফ সি আর দাশ। ব্রিটিশ পাথে, ১৯২৫।


হাত-পাখা নিয়ে শোকযাত্রার স্থিরচিত্র। সূত্র: ফিউনারেল প্রসেশন অফ সি আর দাশ। ব্রিটিশ পাথে, ১৯২৫।

চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর ১৪ বছর আগে, ১৯১১–তে চার্লস পাথে প্রথম নিউজ–রীল আবিষ্কার করেন, চলচ্চিত্র শুরু হবার আগে দেশ–বিদেশের খবরাখবর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। হয়তো সেই ভেবেই পাথে–র চিত্রগ্রাহকেরা চিত্তরঞ্জনের শেষ যাত্রা ভিঢিও রেকর্ড করেছিলেন। কিন্তু সেই মাসের স্টেটসম্যানের একটি বিজ্ঞাপন থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারি যে এই ভিডিও–টির একটা স্বতন্ত্র আকর্ষণও ছিল। “চিত্তরঞ্জন দাশের অবিস্মরণীয় শেষ যাত্রা দেখুন... দেখুন, একটা গোটা শহর শোকাচ্ছন্ন... মানুষের অভূতপূর্ব ভিড় যা ভারতবর্ষে কোথাও দেখা যায় নি।” এ ছাড়াও দর্শকবৃন্দকে লোভ দেখানো হয় এই বলে যে, “মহাত্মা গান্ধী এবং আরও কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির ভিডিও–ও ধরা রয়েছে কিছুদিন আগের এক জনসভার থেকে।” কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে এই ক্লিপটি প্রদর্শিত হয়, যেমন ম্যাডেন থিয়েটার অ্যান্ড প্যালেস অফ ভ্যারায়টিস, যারা হলিউডের ছবি আমদানি করত ভারতে, এবং পাথে–র সাথেও যাদের আদান–প্রদানের সম্পর্ক ছিল। এমন হতে পারে যে বিজ্ঞাপনেটিতে যে কিল্প–এর কথা বলা হচ্ছে, তা প্যাথে–র আর্কাইভের রীল–টা নয় কিন্তু একাধিক রেকর্ডিং হয়ে থাকার সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়। বা হয়তো প্রদর্শিত ক্লিপ–টি আর্কাইভের ক্লিপ–এর কোন হারিয়ে–যাওয়া পূর্ণ সংস্করণ।


টাইটেল কার্ড। সূত্র: ইন্ডিয়া: দি এম্পায়ার্স গ্রেটেস্ট প্রব্লেম টুডে। ব্রিটিশ পাথে, ১৯২৯।

এর কয়েক বছর বাদে, যতীন্দ্র নাথ দাসের (১৯০৪ – ১৯২৯) অনশন এবং মৃত্যুর পর লাহোরের রাস্তায় বিরাট শোকযাত্রার রেকর্ডিং–ও পাথে–র তরফ থেকে করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে অবশ্য টাইট্‌ল কার্ডে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করে লেখা হয়, “দেশপ্রেমে উন্মত্ত জনতার মতে না কি ইনি শহীদ হয়েছেন – রাজনৈতিক কর্মী, যতীন্দ্র নাথ দাস, যিনি ৬১ দিন অনশনের পর প্রাণ হারান।” ২ মিনিট ২২ সেকন্ডের এই ক্লিপ–টির শিরোনাম “ইন্ডিয়া – দ্য এম্পায়ার্স গ্রেটেস্ট প্রব্লেম টুডে” অর্থাৎ, ব্রিটিশদের সব চেয়ে বড় মাথাব্যাথার কারণ। তবে পাথে–র শোকযাত্রার ভিডিও–র মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডিং সম্ভবত গান্ধীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার, যেখানে ধরা রয়েছে ওনার জ্বলন্ত চিতার ছবিও। ফিউনারেল প্রসেশান বা কোন ব্যক্তিত্বের মৃত্যু কেন্দ্র করে সর্বজনীন শোকযাত্রার প্রচলন আলোকচিত্র বা চলচ্চিত্রের যুগের আগেও ছিল, বিশেষত কলকাতার বা অন্যান্য ঔপনিবেশিক শহরের আশপাশে ইউরোপীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। কিছু ধনী হিন্দু, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের মধ্যেও এই রীতি লক্ষণীয়।


লাহোরের রাস্তায় যতীন্দ্র নাথ দাসের মৃত্যুর পর শোকযাত্রা। সূত্র:  ইন্ডিয়া: দি এম্পায়ার্স গ্রেটেস্ট প্রব্লেম টুডে । ব্রিটিশ পাথে, ১৯২৯।

কিন্তু এই বিজ্ঞাপনে যে ভাবে চিত্তরঞ্জনের শোকযাত্রাকে জনসাধারণের জন্য এক দ্রষ্টব্য আকর্ষণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে, তার থেকে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে আসে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বঙ্গসমাজের সেই “পাব্লিক,” প্রযুক্তি, এবং সমষ্টিগত আবেগের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল তার ব্যাপারে। একদিকে আমরা এই অভিজ্ঞতার কথা ভাবতে পারি সেই শোকযাত্রার আবেগপূর্ণ মুহূর্তে, প্রযুক্তির মাধ্যমে, আরও বহু মানুষের অংশগ্রহণ করার এক সুযোগ হিসেবে। আবার অন্যদিকে হয়তো জনসাধারণের শোক প্রকাশের এই দৃশ্যগুলো তুলে ধরা হচ্ছে অন্য এক “পাব্লিক”–এর জন্য, যাঁরা সাংবাদিক গার্ভিনের মতনই, নিজেদের নৃতাত্ত্বিক কৌতূহল মিটিয়ে নিচ্ছেন সিনেমার পর্দার আলোছায়ার মধ্যে দিয়ে। পুরোপুরি বিযুক্ত বা স্বতন্ত্র না হলেও এই মুহূর্তে যেন আমরা দেখতে পাচ্ছি রবীন্দ্রনাথের সেই নবীন “পাব্লিক”–এর দুটো পৃথক অবতার। অস্বীকার করা যায় না যে দুই দলের মধ্যে ওভারল্যাপ থাকতে পারে, যেমন একজন ব্যক্তি খুব স্বাভাবিক ভাবেই শোকযাত্রা এবং সিনেমা হলের “পাব্লিক”–এর অংশ হতেই পারেন। তবুও সেই দুটি অভিজ্ঞতা প্রযুক্তির পর্দার দু–দিকে অবস্থিত। এক দল রাস্তায়, শোক যাত্রার সশরীরী অংশীদার, অন্যেরা সিনেমা হলে পরোক্ষ দর্শক। ঐতিহাসিক মুহূর্তটির সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ঠিক কতটা আলাদা – তা ভাববার বিষয়।